টিআইসি
বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হল ভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম। আর আমাদের এই সংগ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমি ও গুরুত্ব বিবেচনায় ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং মর্যাদার সাথে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এই সংগ্রামের সময় তথ্য কিংবা যোগাযোগের সুব্যবস্থা না থাকায় শুধু রাজধানী ঢাকার আন্দোলন ও এর ইতিহাস সকলের কাছে স্মরণীয়। কিন্তু রাজধানীর সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অন্যান্যদের পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বহু উদ্যমী তরুণ ও শিক্ষার্থীর-জনতা ভাষা সংগ্রামে নিজ নিজ এলাকায় নিজ অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো লালমনিরহাটেও ভাষা আন্দোলনের সময় উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
জেলায় মোট ভাষা সৈনিক ১২জন যাদের মধ্যে ১১জন মারা গেছেন। একমাত্র জীবিত ভাষা সৈনিকের নাম আবদুল কাদের ভাসানি। আর যারা মারা গেছেন তারা হলেন আশরাফ আলী, কমরেড সিরাজুল ইসলাম, ড. শাফিয়া খাতুন, আবদুল বুদ্দুছ, মনিরুজ্জামান, মহেন্দ্র নাথ রায়, কমরেড শামসুল হক, জরিনা বেগম, আবিদ আলী, জাহানারা বেগম (দুলু) ও জহির উদ্দিন।
জীবিত ও প্রয়াত ভাষা সৈনিকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ও জেলার ইতিহাসে যে বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল।
জানা যায়, দেশের অন্যান্য এলাকার মতো লালমনিরহাটের ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীরা সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৮ থেকে শুরু ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় পালিত কর্মসূচির সাথে যতটা সম্ভব তাল মিলিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করেছেন তারা। ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। ওই পরিষদের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত জহির উদ্দিন আর সম্পাদক ছিলেন আবদুল কাদের ভাসানি। হরতালকে সমর্থন দিয়ে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন ভাষা সৈনিকের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী ক্লাস বর্জন করেন। তারা সকলে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। খবর পেয়ে পুলিশ স্কুলের গেটে হাজির হন এবং আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করতে স্কুলে প্রবেশ করতে চান। কিন্তু বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক পুলিশকে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় তারা শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করার জন্য বিদ্যালয়ের গেটের সামনে অবস্থান নেন। তবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পুলিশ সদস্যরা ফিরে যান। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে তখন বিদ্যালয়ে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা পিছনে থাকা সুইপার কলোনি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু তাদের অনেককেই চিহ্নিত করে পুলিশ। তাই কারণে-অকারণে তাদেরকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হতো ও আটকে রাখা হতো। আর তাই আত্মরক্ষার্থে তারা আত্মগোপনে চলে গিয়ে সেই অবস্থান থেকেও আন্দোলন চালিয়ে যান। এছাড়াও সে সময় লালমনিরহাট শহরে ছাত্র ও জনতা মিছিল মিটিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেন।
জেলার ভাষা সৈনিকদের ব্যক্তিগত অবদানের সংক্ষিপ্তরূপ-
• প্রয়াত মনিরুজ্জামান ১৯৪৮ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে আই এ পড়তেন। সে সময় তিনি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালের ২২ফেব্রুয়ারি হরতাল সমর্থনে তিনি পিকেটিং এ অংশ নেন। সে সময় ঢাকার চকবাজার উর্দু রোডে তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন।
• প্রয়াত কমরেড মোঃ সিরাজুল ইসলাম একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় স্থানীয় শিক্ষার্থীদের অর্থ দিতেন ও তাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সাহস যোগাতেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থনে তিনি ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করেন ও মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। পরে পুলিশ এসে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং তিনি গ্রেপ্তার হন।
• প্রয়াত আশরাফ আলী ভাষা আন্দোলনের সময় লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের ডিটিএস অফিসে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জেলার ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্র ও জনতাকে তিনি তার বেতনে থেকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনেক ছাত্র ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন এই খবর পেয়ে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। আর তাই রেলওয়েতে কর্মরত বাঙালি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠিত করে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। নিজের চাকুরি হারানোর ভয়কে জয় করে ওই মিছিলের নেতৃত্ব দেন সাহসী এই ভাষা সৈনিক।
• আব্দুল কাদের ভাসানি লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। লালমনিরহাটের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি সক্রিয় ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।
• প্রয়াত ডঃ শাফিয়া খাতুন ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে যান। তিনি সে সময় ঢাকাতে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহপাঠিদের সাথে অংশগ্রহণ করেন।
• প্রয়াত ভাষা সৈনিক আব্দুল কুদ্দুস ভাষা আন্দোলনের সময় রংপুরের কারমাইকেল কলেজে আইএ পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে যান এবং প্রশংসনীয় অবদান রাখেন।
• প্রয়াত কমরেড শামসুল হক ১৯৫২ সালে লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় আন্দোলনে জড়িয়ে যান। তিনি লালমনিরহাটে গঠিত ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সংগঠনের সকল কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন।
• প্রয়াত মহেন্দ্র নাথ রায় ১৯৫২ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে আইএ ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠনের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ১৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকা বিশবিদ্যাল্যের ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে ছাত্রদের গোপন বৈঠকেও অংশ নেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি রংপুরে ফিরে আসেন। কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি করা ও নির্যাতনের খবর পেয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি তৎকালীন রংপুর ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল অফিসের সামনে প্রতিবাদ সভার আহ্বান জানান। পুলিশ সেই সভা ভণ্ডুল করে দেয় এবং ঘটনাস্থল থেকে শামসুল হকসহ আরও কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন এবং কারমাইকেল কলেজ হল্রুমে একটি প্রতিবাদ সভা করেন।
• প্রয়াত জহির উদ্দিন আহম্মদ লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। লালমনিরহাটের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি সক্রিয় ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।
• প্রয়াত আবিদ আলী ১৯৫২ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে আইএ পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে যান এবং প্রশংসনীয় অবদান রাখেন।
• প্রয়াত জরিনা বেগম ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে অবস্থিত তৎকালীন মেডিকেল স্কুলে এলএমএফ ডাক্তারি কোর্সে অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই কারণে তাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ছাত্রী হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরও তিনি সক্রিয় থাকায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। পরে তিনি আত্মগোপনে যান এবং বাড়ি ফিরে আসেন।
• প্রয়াত জাহানার বেগম দুলু ভাষা আন্দোলনের সময় লালমনিরহাট বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তেন এবং আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি আন্দোলনের উত্তাল সময়ে রাত জেগে পোস্টার লিখতেন। তার কাছ থেকে সেই পোস্টার সংগ্রহ করে স্থানীয় ছাত্রনেতারা খুব সকালে সেগুলো দেয়ালে লাগাতেন। প্রথমদিকে বিষয়টি গোপন থাকলেও পরে জানাজানি হয়। ফলে পুলিশ কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে তাকেও আটক করে। কয়েক ঘণ্টা আটক থাকার পর তৎকালীন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মেয়ে মমতাজের সহযোগিতায় তিনি ছাড়া পান। এরপর তিনি তার কার্যক্রম আরও জোরদার করেন এবং বিভিন্ন মিছিলে-মিটিং এ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদের ভাসানি ও প্রয়াত কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিবছর মহান শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই কেবল জেলা প্রশাসন তাদের রুটিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে যোগাযোগ করেন কিংবা সংবর্ধনা দেন। কিন্তু বছরের বাকিটা সময় তারা কেমন আছেন সেই খোঁজ কেউ রাখেন না।
জেলাবাসির দাবি স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তারা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান পান ভাষা সৈনিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও সেই সম্মান পাওয়ার সমঅধিকার রয়েছে।