টিআই চঞ্চল
নারী কখনও মা, কখনও বোন, কখনও স্ত্রী। ভিন্নরূপে ঘরকে আলোকিত করে রাখেন তারা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও নারীদের অবস্থান সম্মানোনীয়। আর বাঙালি জাতির ঐতিহ্য আর সংগ্রামের ইতিহাসে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। যেই নারী মমতাময়ী সেই নারী রুদ্রমূর্তিও ধারণ করতে সক্ষম। বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অবদান চিরস্মরণীয়। যেমন- বীর প্রতীক তারামন বিবি। যুগে যুগে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা যেমন সংগ্রাম করেছে তেমনই শিক্ষা কিংবা পেশার ক্ষেত্রেও ঘাত-প্রতিঘাত, বাঁধা কিংবা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজেদের যোগ্যতাকে বারবার প্রমাণ করেছেন। ঠিক তেমনই একজন নারী লালমনিরহাটের ফরিদা বেগম। যিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ট্রেন চালনা অর্থাৎ তিনি একজন ট্রেন চালক।
বাংলাদেশ রেলওয়েও হাতেগোনা কয়েকজন নারী ট্রেনচালকের মধ্যে তিনিও একজন। পদবি এএলএম (অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমেটিভ মাস্টার)-গ্রেড ২। এ পেশায় তিনি ১০ বছর ধরে কাজ করছেন।
কেন ট্রেন চালকের পেশা বেছে নিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে ৪ সন্তানের জননী ফরিদা বলেন, “আমার ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল কোন চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলবো। আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে আগ্রহী এবং সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে জয়ী হতে চাই। আমি যখন দেখলাম এএলএম ( অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমেটিভ মাস্টার) গ্রেড-২ একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। আর মেয়েদের জন্যতো আরও চ্যালেঞ্জিং কারণ দিন-রাত যেকোনো সময় ডিউটি করতে হয়। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত যেতে হয়। তখন নারী এলএম হওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। আর আমি সফল হতে চাই। আমি জয়ী হতে চাই। আমার জয়ী হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ঘার কারণেই এই চ্যালেঞ্জিং পেশাকে বেছে নিয়েছি।“
পারিবারিক দিক থেকে কোন বাঁধা আছে কি এই প্রশ্নে ফরিদা বলেন, “আমার দুটি মেয়ে ও দুটি ছেলেসহ মোট চারটি সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ের বয়স ১০, ছোট মেয়ে ৭ বছর। অন্যদিকে বড় ছেলের ২ বছর আর ৯ মাসের ছোট ছেলেকে বাড়িতে রেখে এসেছি। পরিবারের সাপোর্ট ছাড়া এটা করা সম্ভব ছিল না। আমার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির সবাই আমাকে অনেক সাপোর্ট করেন।“
কর্মক্ষেত্রে কিংবা সহকর্মীদের বিষয়ে ফরিদা বলেন, “সহকর্মীদের সাপোর্টটা অনেক জরুরি। আমি অনেকের সাপোর্ট পাই যেমন আমার সহকর্মী এলএম ভাইয়েরা, এছাড়াও কর্মকর্তা যেমন ডিএমই স্যার, লোকো ফোরম্যান স্যার, সংগঠনের নেতারা সাপোর্ট করেন।, আমাকে উৎসাহ দেন ও অনুপ্রেরণা জোগান। বাইরে ট্রেন নিয়ে গেলে এলএম ভাইয়েরা অনেক বেশি সহযোগিতা করেন। এছাড়াও আমাকে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেন। যার ফলে আমি কাজ করতে পারছি।“
ট্রেনের ইঞ্জিনে দায়িত্ব পালনে কি কোন সমস্যা হয় এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “একটা মেয়ের জন্য ট্রেনের ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সমস্যা খুঁজে বের করা ও সমাধান করাও কঠিন। কিন্তু আমি তা করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার এলএম একবার বলেছিল হোস পাইপের সমস্যা দেখতে, আমি দেখি যে সেটি থেকে হাওয়া বেরিয়ে গেছে যার ফলে ট্রেনের ইঞ্জিন অটোমেটিক দাঁড়িয়ে যাবে। ঠিক না করা পর্যন্ত চলবেনা। ইঞ্জিন চেক করে বের হওয়ার পরও পথিমধ্যে এমন নানা সমস্যা দেখা দেয়। আর তাই এগুলো জানতে হয়। কিছু রুটিন কাজ আছে যেমন ট্রেনের যান্ত্রিক ত্রুটি, কম্প্রেসার তেল চেক করা, পানি চেক করা, আন্ডার গিয়ারের কাজ সেগুলোও দেখতে হয়। সব কিছু ঠিক থাকলে তা এলএমকে জানালে তবেই ট্রেন ছাড়েন। এসব আমি পারি কারণ তারা আমাকে এগুলো শিখতে সহযোগিতা করেছেন।“
অন্য নারীরা যারা এ পেশায় আসতে চান তাদের উদ্দেশ্যে ফরিদা বলেন, “মেয়েদেরকে নিয়ে সবাই ভয়ে থাকে এই ভেবে যে তারা হয়ত কাজটা পারবেন না। কিন্তু সাপোর্ট পেলে মেয়েরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। কোন মেয়ে যদি পরিবার থেকে সাপোর্ট পায় তবেই সে এ ধরনের পেশায় সফল হতে পারবে। তানাহলে এ পেশায় আসতেই পারবেন না। সব থেকে বড় কথা জীবনে যেকোনো চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে হবে ও সাহস থাকতে হবে, তবেই সম্ভব।“
নারী ট্রেন চালক ফরিদার বিষয়ে কয়েকজন নারী যাত্রীর অনুভূতি জানতে চাইলে তারা জানান, যখন তারা দেখেন যে একজন নারি ট্রেন চালাচ্ছেন তখন অনেক অনুপ্রাণিত হন। নারীর হয়েও পুরুষদের সাথে একই কাজ করছে এটা দেখে তাদের খুব ভালো লেগেছে। এ বিষয়টি নারী জাতির জন্য অনেক গর্বের বলে মনে করেন তারা ।
ট্রেন চালক (এলএম) সামসুদ্দিন জানান, ট্রেনে নারী চালকদের নিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি কারণ অনেক সময় রাতেও ডিউটি থাকে। এছাড়াও ন্যূনতম কিছু সুযোগ সুবিধা থাকা যেমন থাকা খাওয়া, গোসল বা নারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা থাকা। তিনি আশা করেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
তিনি আরও জানান, ফরিদা সহকর্মী হিসেবে ভাল ও কাজে পারদর্শী।
বাংলাদেশ রেলওয়ে লালমনিরহাট বিভাগীয় লোকো ইনচার্জ (এসএসএই/আইসি/লোকো) মো. কাজী সুমন, বলেন, “নারীরা এখন আর ঘরের মধ্যে বন্দী নেই। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের এএলএম যে নারীরা আছেন তারাও কাজে কর্মে অনেক ভাল করছেন। কাজের ক্ষেত্রে তাদের গাফিলতিও কম। যা ইতিবাচক।“
নারীরা ডিসি, এসপি থেকে শুরু করে বিমানের পাইলট হয়েছেন। ট্রেন চালক হিসেবে হাতেগোনা নারীদের তালিকায় যেমন ফরিদা নাম লিখিয়েছেন তাকে দেখে অন্য নারীরাও উৎসাহিত হবেন বলে মন্তব্য করেছেন জেলার নারী অধিকার কর্মীরা।